বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্ত
বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্ত | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯১০ | (বয়স ২১)
আন্দোলন | ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন |
বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্ত (২০ জুন ১৮৮৯ - ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯১০) ছিলেন পরাধীন ব্রিটিশ ভারতের অগ্নিযুগের এক অবিস্মরণীয় শহীদ বিপ্লবী। ১৮৮৯ সালের ২০ শে জুন অধুনা বাংলাদেশের ঢাকায় এই নির্ভীক দেশপ্রেমিকের জন্ম।[১] প্রথম যৌবনেই তার ভারতের সমকালীন রাজনীতিতে প্রবল আগ্রহ জন্মায় এবং তিনি সক্রিয় বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান তদন্তকারী আধিকারিক পুলিশ বিভাগের সহ-অধীক্ষক (ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ) সামশুল আলম হত্যা মামলার বিচারে বীরেন্দ্রনাথের ফাঁসি হয়।
প্রথম জীবন
[সম্পাদনা]১৮৮৯ সালের ২০ শে জুন ঢাকা বিক্রমপুরের বালিগাঁও গ্রামে জন্ম হয় বীরেন্দ্রনাথের। বাবা উমাচরণ এবং মা বসন্তকুমারীর দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন তিনি। খুব ছোট বয়সেই তার পিতৃবিয়োগ হয়। ১৯০৮ সালে বীরেন্দ্র জলপাইগুড়ি জিলা স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। পরবর্তীকালে তিনি কলকাতায় আসেন এবং আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলার রাজসাক্ষী নরেন গোঁসাইয়ের হত্যাকারী শহীদ বিপ্লবী কানাইলাল দত্তের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সক্রিয় বিপ্লবী কার্যকলাপে আকৃষ্ট হন। এই সময় তিনি যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ওরফে বাঘা যতীনের শিষ্য হিসেবে বিপ্লবাত্মক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন।[১]
সামশুল আলম হত্যার পটভূমি
[সম্পাদনা]কলকাতা হাইকোর্টে আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলা রুজু হওয়ার পর বাংলায় গুপ্ত বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড প্রায় প্রকাশ্যে চলে আসে। এর মূলে ছিলেন তিন রাজকর্মচারী — ইন্সপেক্টর নন্দলাল ব্যানার্জি, উকিল আশুতোষ বিশ্বাস এবং ডি.এস.পি সামশুল আলম। এঁদের হত্যা করা বিপ্লবীদের কাছে আবশ্যিক হয়ে পড়েছিল। শহীদ প্রফুল্ল চাকীকে মোকামাঘাট স্টেশনে গ্রেফতারের প্রচেষ্টার জন্য কলকাতার সার্পেন্টাইন লেনে তাকে গুলি করে মারেন শ্রীশচন্দ্র পাল।[২] এরপর আলিপুর মামলার পাবলিক প্রসিকিউটর আশুতোষ বিশ্বাসকে হত্যা করেন চারুচন্দ্র বসু। বাকি ছিলেন ওই ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান তদন্তকারী আধিকারিক সামশুল আলম। বিপ্লবীরা তাকে নিয়ে গান বেঁধেছিলেন - 'ওহে সামশুল/তুমি সরকারের শ্যাম, আমাদের শূল/কবে ভিটেয় তোমার চরবে গরু/তুমি দেখবে চোখে সর্ষেফুল'।[৩] ১৯০৯ সালের ৬ই মে আলিপুর মামলার রায় ঘোষণা হয়। রায়ে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত সহ বহু বিপ্লবী দোষী সাব্যস্ত হন এবং তাদের সাজা ঘোষণা করা হয়। এই পরিস্থিতিতে যতীন্দ্রনাথ তার প্রিয় শিষ্য বীরেন্দ্রর কাঁধে সামশুল আলমের হত্যার দায়িত্ব অর্পণ করেন।
সামশুল হত্যা এবং বীরেন্দ্রনাথের বিচার
[সম্পাদনা]১৯১০ সালের ২৪শে জানুয়ারি, হাইকোর্টের বারান্দায় প্রকাশ্য দিবালোকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে বীরেন্দ্র গুলি করেন সামশুল আলমকে। তারপর গুলি করতে করতে আদালত চত্বর থেকে পালাতে চেষ্টা করেন তিনি। দুর্ভাগ্যবশত তার রিভলবারের গুলি ফুরিয়ে যাওয়ার পর আদালতের রক্ষীরা এসে তাকে ধরে ফেলে। পুলিশি জেরায় তিনি কোনো গোপন তথ্য ফাঁস করেননি। এমনকী হাইকোর্টে বিচার চলাকালীন আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কোনো উকিলের সাহায্য নিতেও তিনি অস্বীকার করেন। বিচারপতি লরেন্স জেঙ্কিন্স ব্যারিস্টার নিশীথ সেনকে আসামীপক্ষের উকিল হিসেবে নিযুক্ত করেন। কিন্তু বিপ্লবীদের গুপ্ত সংবাদ প্রকাশ হওয়ার আশঙ্কায় বীরেন্দ্র নিশীথ সেনকে একটি কথাও জানাতে সম্মত হননি। আদালতে নিশীথ সেন বীরেন্দ্রকে বিকৃতমস্তিস্ক বলে উল্লেখ করেন। তবু শেষ পর্যন্ত বিচারে বীরেন্দ্রকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়।[৩]
এক জঘন্য ষড়যন্ত্র এবং বীরেন্দ্রনাথের স্বীকারোক্তি
[সম্পাদনা]সামশুল আলম হত্যার অব্যবহতি পরে কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের হয়। এটি ইতিহাসে হাওড়া-শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলা বলে পরিচিত। এই মামলায় ডি.এস.পি সামশুল আলম খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বাঘা যতীন সহ ৪৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু সেই অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করা সরকারের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল। কারণ আলমের হত্যাকারী বীরেন্দ্র পুলিশের একটি প্রশ্নেরও উত্তর দেননি। এই পরিস্থিতিতে সরকার একটি জঘন্য চক্রান্তের পরিকল্পনা করে। বীরেন্দ্রর হাতে তুলে দেওয়া হয় ওদেরই বিপ্লবীদলের এক গোপন ইস্তাহারের অনুরূপ একটি কাগজ, যেটি আদতেও সেই বিপ্লবীদলের নয়। সেই কাগজে যতীন্দ্রনাথ 'স্বাক্ষরিত' (বলাই বাহুল্য স্বাক্ষরটি অনুকৃত) একটি নিবন্ধে সামশুল হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটিকে পুলিশের পূর্বপরিকল্পিত বলে দাবি করা হয়। বলা হয় যে সামশুল আলম কে বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্ত হত্যা করেননি। হত্যা করেছেন সতীশ সরকার নামে একজন। একই সঙ্গে ওই নিবন্ধে বীরেন্দ্রকে পুলিশের চর হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বীরেন্দ্রনাথ পুলিশের এই চক্রান্তের বিন্দুবিসর্গ অনুমান করতে পারেননি। তার ধারণা হয়েছিল যতীন্দ্রনাথ মিথ্যাচার করে তাকে স্বদেশবাসীর কাছে বিশ্বাসঘাতক প্রতিপন্ন করেছেন। এই কলঙ্কমোচনের জন্য বীরেন্দ্র মরিয়া হয়ে ওঠেন এবং ফাঁসির আগের দিন (২০শে ফেব্রুয়ারি, ১৯১০) তিনি তার স্বীকারোক্তিতে জানান যে তিনিই যতীন্দ্রনাথের নির্দেশে সামশুলকে হত্যা করেছেন। বীরেন্দ্রর এই স্বীকারোক্তিতে যতীন্দ্রনাথ সহ আরো অনেক বিপ্লবী এক গভীর সমস্যার সম্মুখীন হন। ১৯১০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি অধুনা আলিপুর প্রেসিডেন্সি জেলে বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্তের ফাঁসি হয়।[৩][৪][৫]
বীরেন্দ্রনাথের ফাঁসির পরবর্তী সময়ে বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন
[সম্পাদনা]যদিও শেষ পর্যন্ত বীরেন্দ্রনাথের স্বীকারোক্তির ফায়দা তুলতে পারেনি সমকালীন পুলিশ প্রশাসন। তার মূলত দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, বাকি বিপ্লবীদের বিচার শুরু হওয়ার আগেই বীরেন্দ্রনাথের ফাঁসি হয়ে যাওয়ায় বহুক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোর সত্যতা যাচাইয়ের সুযোগ পায়নি প্রশাসন। দ্বিতীয়ত, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন যতীন্দ্রনাথের সিদ্ধান্তে বিপ্লবী গুপ্ত সমিতিগুলোর মধ্যে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীভূত থাকায় সরকার বিপ্লবীদের পারস্পারিক যোগাযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়। ফলস্বরূপ বন্দী ৪৭ জন বিপ্লবীর মধ্যে যতীন্দ্রনাথ সহ ৩৩জনকে প্রশাসন মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর যতীন্দ্রনাথ চাকরি থেকে বরখাস্ত হন এবং সম্পূর্ণরূপে বৈপ্লবিক কার্যকলাপে আত্মনিয়োগ করেন। অন্যান্য বিপ্লবীরাও একই ভাবে পুনরায় নিজেদের কাজে মনোনিবেশ করেন। তাই বীরেন্দ্রনাথের স্বীকারোক্তির ফলে ব্রিটিশ সরকার বাংলায় বৈপ্লবিক আন্দোলনের যে অবমন্দন আশা করেছিলো, তা কখনোই বাস্তবায়িত হয় নি।[৩][৬]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ শুভেন্দু মজুমদার। অগ্নিযুগের ফাঁসি।
- ↑ শৈলেশ দে। ক্ষমা নেই। কলকাতা: বিশ্বাস পাবলিশিং হাউস।
- ↑ ক খ গ ঘ নারায়ন সান্যাল। আমি রাসবিহারীকে দেখেছি। কলকাতা: করুনা প্রকাশনী।
- ↑ "West Bengal Correctional Services"।
- ↑ "MN Roy: brief outline of life-events and thoughts- Part 02"।
- ↑ "হাওড়া-শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলা"।
Text is available under the CC BY-SA 4.0 license; additional terms may apply.
Images, videos and audio are available under their respective licenses.