For faster navigation, this Iframe is preloading the Wikiwand page for ক্রিটেশিয়াস–প্যালিওজিন বিলুপ্তির ঘটনা.

ক্রিটেশিয়াস–প্যালিওজিন বিলুপ্তির ঘটনা

Meteoroid entering the atmosphere with fireball.
একজন শিল্পীর ভাষ্যে পৃথিবীর সাথে একটি গ্রহাণুর সংঘর্ষ। এই ধরনের ঘটনা কয়েক মিলিয়ন পারমাণবিক অস্ত্রের সমান শক্তি একযোগে বিস্ফোরিত করতে পারে।

ক্রিটেশিয়াস-প্যালিওজিন (K-Pg) বিলুপ্তি ঘটনা (মতান্তরে ক্রিটেশিয়াস-টার্শিয়ারি (K-T) বিলুপ্তি ঘটনা) বলতে আজ থেকে প্রায় ৬.৬ কোটি বছর আগে পৃথিবীর জীবজগতের প্রায় তিন চতুর্থাংশের আকস্মিক বিলোপনের ঘটনাকে বোঝায়[][][]। সামুদ্রিক লেদারব্যাক কচ্ছপ ও কুমির ছাড়া ২৫ কিলোগ্রামের বেশি ওজনের কোনও চতুষ্পদ এই বিলোপনের হাত থেকে নিস্তার পায়নি[]। এটি ক্রিটেশিয়াস যুগ তথা মেসোজোয়িক মহাযুগের অবসান ও বর্তমান সিনোজোয়িক মহাযুগের আরম্ভের সূচক ঘটনা।

ভূতাত্ত্বিক খতিয়ানে ক্রি-প্যা ঘটনাটির নির্দেশক হল ক্রি-প্যা সীমানা নামক একটি পাতলা অধঃক্ষেপের আস্তরণ, যা পৃথিবী জুড়ে স্থল ও সমুদ্রের তলদেশের শিলাস্তরে পাওয়া যায়। সীমানাটির রাসায়নিক বিশ্লেষণে অত্যধিক মাত্রায় ধাতব মৌল ইরিডিয়ামের সন্ধান পাওয়া যায়, যা পৃথিবীর শিলামণ্ডলে বিরল হলেও গ্রহাণুতে সহজলভ্য।

১৯৮০ খৃঃ বিজ্ঞানী লুই আলভারেজ ও তার পুত্র ওয়াল্টার আলভারেজ একটি বিজ্ঞানী দলের মুখপাত্র হিসেবে একটি ধারণা দেন যা এখনও পর্যন্ত স্বীকৃত। তারা বলেন, ক্রি-প্যা বিলোপনের কারণ হল ৬.৬ কোটি বছর আগে ১০ থেকে ১৫ কিমি. ব্যাসের একটি ধূমকেতু বা গ্রহাণুর সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষ। এর ফলে সারা পৃথিবীর পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যায়। প্রধানত একটি সুদীর্ঘ সংঘর্ষজাত শীতকালকে এর জন্য দায়ী করা হয়, যার ফলে উদ্ভিদ ও প্ল্যাঙ্কটনের সালোকসংশ্লেষ বন্ধ হয়ে গিয়ে খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়ে। এই সংঘর্ষ তত্ত্বের অপর নাম আলভারেজ তত্ত্ব, এবং এটি ১৯৯০ এর দশকের প্রথম দিকে মেক্সিকো উপসাগরের তীরবর্তী ইউকাটান উপদ্বীপে ১৮০ কিমি. চওড়া চিক্সুলাব উল্কাখাত আবিষ্কারের পর দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হয়। মহাবিলুপ্তিটি যে একই সঙ্গে সর্বত্র ঘটেছিল, তা থেকে আরও জোরদার ধারণা হয় যে উল্কাটিই এর জন্য দায়ী। ২০১৬ খৃঃ চিক্সুলাব খাতের কিনারার বলয়ে একটি ড্রিলিং প্রকল্প নিশ্চিত জানায় যে বলয়টি এমন গ্রানাইট পাথরে নির্মিত যা ভূগর্ভের গভীর থেকে কয়েক মিনিটের মধ্যে উৎসারিত হয়েছিল। অথচ তাতে সালফেট-সমৃদ্ধ জিপসামের ভাগ খুবই কম, যা কিনা আঞ্চলিক সমুদ্রতলের ভূত্বকের সাধারণ উপাদান। সংঘর্ষের অত্যধিক উত্তাপে জিপসাম বাষ্পায়িত হয়ে হাওয়ায় মিশে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল, আর জলবায়ু ও খাদ্যশৃঙ্খলের উপর সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছিল।

মহাবিলুপ্তির অন্যান্য সম্ভাব্য কারণের মধ্যে দাক্ষিণাত্য ও অন্যত্র আগ্নেয়োচ্ছ্বাস, জলবায়ু পরিবর্তন, ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব থাকতে পারে।

ক্রি-প্যা মহাবিলুপ্তিতে অনেক প্রজাতি লুপ্ত হয়ে যায়, যাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল উড্ডয়নে অক্ষম ডাইনোসরকুল। এছাড়াও অনেক স্তন্যপায়ী, টেরোসর, পাখি, গিরগিটি, পতঙ্গ, ও উদ্ভিদ সমেত অনেক প্রজাতি ধ্বংস হয়। মহাসাগরে এই বিপর্যয় প্লীসিওসর এবং দৈত্যাকার সামুদ্রিক গিরগিটি মোসাসরদের বিনাশ করে, আর মাছ, হাঙর, কম্বোজ (বিশেষতঃ অ্যামোনাইট, যারা লোপ পায়), ও প্ল্যাঙ্কটনের অনেক প্রজাতি বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অনুমান করা হয় সমগ্র জীবজগতের ৭৫% বা তার বেশি এই মহাবিলুপ্তির গ্রাস হয়েছিল। এত সত্ত্বেও এই বিপর্যয় থেকেই আবার নতুন জীবনের সুযোগেরও সৃষ্টি হয়; অনেক প্রাণিগোষ্ঠী অভিযোজনীয় বিকিরণের মধ্য দিয়ে যায় অর্থাৎ অল্প সময়ের মধ্যে অনেক আলাদা আলাদা প্রজাতিতে ভাগ হয়ে গিয়ে বাস্তুতন্ত্রের ফাঁকা হয়ে যাওয়া ধাপগুলির দখল নেয়। বিশেষতঃ প্যালিওজিন যুগে স্তন্যপায়ীরা বহু ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়, যে বিবর্তনের ফলে ঘোড়া, তিমি, বাদুড়, ও প্রাইমেটদের উদ্ভব। পাখি, মাছ ও সম্ভবতঃ টিকটিকিরাও অনুরূপ বিকিরণের মধ্য দিয়ে বহু প্রজাতিতে ভাগ হয়েছিল।

বিলুপ্তির বিন্যাস

[সম্পাদনা]
ক্যাম্ব্রিয়ানঅর্ডোভিশিয়ানসিলুরিয়ানডেভোনিয়ানকার্বনিফেরাসপার্মিয়ানট্রায়াসিকজুরাসিকক্রিটেশিয়াসপ্যালিওজিননিওজিন
ফ্যানারোজোয়িক অধিযুগ জুড়ে সামুদ্রিক বিলোপনের হার
%
কোটি বছর আগে
(হ)
ট্রা–জু
পা–ট্রা
ক্যাপ
অন্ত্য ডে
অ–সি
ক্যাম্ব্রিয়ানঅর্ডোভিশিয়ানসিলুরিয়ানডেভোনিয়ানকার্বনিফেরাসপার্মিয়ানট্রায়াসিকজুরাসিকক্রিটেশিয়াসপ্যালিওজিননিওজিন
এই নীল গ্রাফটি প্রদত্ত নির্দিষ্ট সময়কালে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সামুদ্রিক প্রাণীর গণসমূহের আপাত শতাংশ (পরম সংখ্যা নয়) দেখাচ্ছে। এটি সব সামুদ্রিক প্রজাতির প্রতিনিধিত্ব করে না, শুধু সেইগুলি দেখায় যেগুলি নির্দ্বিধায় জীবাশ্ম হয়ে গেছে। প্রথাগত "বৃহৎ পঞ্চ মহাবিলুপ্তি" এবং সম্প্রতি স্বীকৃত আরও দুটি বিলুপ্তি ঘটনার স্তর ক্লিকযোগ্য হাইপারলিংকে দেওয়া হয়েছে; আরও তথ্যের জন্য বিলুপ্তি ঘটনা দেখুন। (উৎস এবং চিত্রের তথ্য)

ক্রি-প্যা বিলুপ্তি ঘটনাটি ছিল প্রবল, বিশ্বব্যাপী, ও দ্রুত; বহুসংখ্যক প্রজাতি এর ফলে লোপ পায়। সামুদ্রিক জীবাশ্ম থেকে অনুমান করা হয় সমসাময়িক জীবজগতের ৭৫% বা তার বেশি এই ঘটনার ফলে লুপ্ত হয়েছিল।

ঘটনাটির প্রভাব প্রতিটি মহাদেশেই একসঙ্গে পড়েছিল বলে মনে করা হয়। বোঝার সুবিধার জন্য উড্ডয়নে অক্ষম ডাইনোসরদের উদাহরণ নিলে দেখা যাবে, এই ধরনের ডাইনোসরেরা পূর্ববর্তী ক্রিটেশিয়াস যুগের শেষ পর্ব মাস্ট্রিক্টিয়ান অধোযুগে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, এবং আণ্টার্কটিকা এই সবক'টি মহাদেশেই পাওয়া যেত, কিন্তু পরবর্তী সিনোজোয়িক অধিযুগে এদের কোত্থাও পাওয়া যায় না। আবার জীবাশ্মীভূত পরাগরেণুতে ধরা ধ্বংসের চিহ্ন পাওয়া যায় নিউ মেক্সিকো, আলাস্কা, চীন, এবং নিউজিল্যান্ডের মত পরস্পর বহুদূরবর্তী অঞ্চল থেকে, একই সময়ে।

ঘটনাটির প্রাবল্য সত্ত্বেও বিভিন্ন ক্লেডের মধ্যে তুলনামূলক বিলোপনের হারে যথেষ্ট তারতম্য ছিল। যে সমস্ত প্রজাতি সালোকসংশ্লেষের উপর নির্ভরশীল ছিল, তারা বায়ুমণ্ডলে ভাসমান ধূলিকণায় সূর্যালোক আটকে ভূপৃষ্ঠে পৌঁছানো সৌরশক্তির পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে লুপ্ত হয়। এইভাবে প্রভাবশালী উদ্ভিদকুলের প্রজাতিগুলি শেষ হয়। সর্বভুক, পতঙ্গভুক, ও মৃতজীবী প্রাণিগোষ্ঠীরা এই বিলুপ্তি ঘটনার পরেও টিকে থাকে, যার সম্ভাব্য কারণ এই ঘটনা তাদের খাদ্যের সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়েছিল। কোনও শুদ্ধ তৃণভোজী বা মাংসাশী স্তন্যপায়ী বেঁচে থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় না। যে সমস্ত স্তন্যপায়ী ও পাখি বেঁচে গিয়েছিল, তারা পতঙ্গ, কেঁচো ও কৃমি, শামুক ইত্যাদি খেয়ে থাকত। ঐ সমস্ত খাদ্য-প্রাণিরা আবার ছিল কর্কর (মৃত প্রাণিজ ও উদ্ভিজ্জ পদার্থ) ভক্ষক।

কর্কর খাদ্যশৃঙ্খলের অন্তর্গত প্রাণিদের মধ্যে বিলোপনের হার ছিল অপেক্ষাকৃত কম, কারণ তারা জীবনধারণের জন্য প্রত্যক্ষভাবে জীবিত উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল না থেকে ডাঙা থেকে ধুয়ে আসা মৃত জৈব পদার্থের উপর নির্ভরশীল ছিল। সমুদ্রের তলদেশের বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রে এই জাতীয়, কিন্তু অনেক বেশি জটিল খাদ্যশৃঙ্খলের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সমুদ্রের মাঝামাঝি গভীরতায় বসবাসকারী জীবজন্তুদের মধ্যে বিলোপনের হার ছিল সমুদ্রের তলার মাটিতে বসবাসকারীদের তুলনায় বেশি। মাঝামাঝি গভীরতার প্রাণিরা প্রায় সম্পূর্ণভাবে জীবিত ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের উপর খাদ্যের জন্য নির্ভর করে; অন্যদিকে সমুদ্রতলের মাটিতে থাকা প্রাণিরা সবসময় বা প্রায়শই কর্কর খেয়ে থাকে। কোকোলিথোফোরিড, কম্বোজ (অ্যামোনাইট, রুডিস্ট, মিঠেজলের শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি) এবং তাদের খেয়ে জীবনধারণ করা প্রাণিরা লোপ পায় বা সংখ্যায় ভীষণভাবে কমে যায়। যেমন, মনে করা হয় অ্যামোনাইটরা ছিল সামুদ্রিক সরীসৃপ মোসাসরদের প্রধান খাদ্য। ক্রিটেশিয়াসের পরে মোসাসরদের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায় না। বায়ুজীবী প্রাণিদের মধ্যে যারা এই বিলুপ্তি ঘটনায় লোপ পায়নি, তাদের মধ্যে আয়তনে সবচেয়ে বড় হল কুমির ও চ্যাম্পোসরদের গোষ্ঠী। এরা উভয়েই ছিল কেবল অংশতঃ জলচর, আর আংশিক কর্করভোজীও বটে। আধুনিক কুমিরেরা 'ধাঙড় খাদক' হিসেবে, তাজা খাবার ছাড়া কয়েক মাস পর্যন্ত বাঁচতে পারে। তাদের বাচ্চারা আকারে ছোট, তাদের বৃদ্ধি হয় অতি ধীরে, এবং জীবনের প্রথম কয়েক বছর অমেরুদণ্ডী ও মৃত প্রাণীদেহ ভক্ষণ করেই তারা জীবনধারণ করে। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে ক্রিটেশিয়াস যুগের শেষে তাদের টিকে থাকার অভিযোজনের অংশ বলে মনে করা হয়।

ক্রি-প্যা ঘটনার পর বাস্তুতন্ত্রের অনেক ধাপ ফাঁকা হয়ে গেলেও জীববৈচিত্র্য পুনরায় আগের পর্যায়ে ফিরে আসতে অনেক সময় লেগেছিল।

অণুজীব

[সম্পাদনা]

সমুদ্রতলে সঞ্চিত যে ক্যালশিয়ামের স্তরের ভিত্তিতে ক্রিটেশিয়াস যুগের নামকরণ হয়েছে, সেই স্তর গঠনকারী ক্যালশিয়াম-সঞ্চয়ক ন্যানোপ্ল্যাঙ্কটনের জীবাশ্মের রেকর্ডে ক্রি-প্যা সীমানা অন্যতম আকস্মিক ও আমূল একটি পরিবর্তনের সূচক। প্রজাতি পর্যায়ে এই পরিবর্তনের অভিঘাত লক্ষ্য করা যায়। সমসাময়িক সামুদ্রিক জীবকুলের ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যানভিত্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বোঝা যায়, এই ব্যাপক নেতিবাচক পরিবর্তনের কারণ ছিল প্রজাতিকরণের আকস্মিক হ্রাস নয়, বরং বিলোপনের আকস্মিক বৃদ্ধি। ডাইনোফ্ল্যাজেলেটদের ক্রি-প্যা সীমানার রেকর্ড ভাল করে বোঝা যায় না, কারণ কেবলমাত্র অণুজীবীয় সিস্টরাই জীবাশ্মীভূত হয়, আর সমস্ত ডাইনোফ্ল্যাজেলেটের জীবনচক্রে সিস্ট নির্মাণকারী দশা থাকে না। এই কারণে তাদের জীববৈচিত্র্যের আসল পরিধি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানও ঝাপসা। সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা যায়, উক্ত সীমানার আগে বা পরে ডাইনোফ্ল্যাজেলেটদের অবস্থায় কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি।

রেডিওল্যারিয়া-রা অন্তত অর্ডোভিশিয়ান যুগ থেকে নিরবচ্ছিন্ন ভূতাত্ত্বিক রেকর্ড রেখে আসছে। তাদের খনিজায়িত জীবাশ্ম ক্রি-প্যা সীমানার আগে ও পরে উভয় সময়কাল থেকেই পাওয়া যায়। এই সমস্ত জীবের গণবিলুপ্তির কোনও ইঙ্গিত নেই, আর দক্ষিণ গোলার্ধের উচ্চ অক্ষাংশে আদি প্যালিওসিনের শীতল আবহাওয়ার ফলে এদের অত্যধিক সক্রিয়তার প্রমাণ মেলে। প্রায় ৪৬% ডায়াটম ক্রিটেশিয়াস থেকে আদি প্যালিওসিনে প্রবেশ করে। প্রজাতির পরিসংখ্যানগত অনুপাতের নিরিখে এটি বেশ বড়মাপের হ্রাস, কিন্তু বিপজ্জনক বিলোপনের মত অত ব্যাপকও নয়।

ক্রি-প্যা সীমানা জুড়ে প্ল্যাঙ্কটনিক ফোরামিনিফেরাদের প্রাপ্তির বিষয়টি ১৯৩০ এর দশক থেকেই চর্চিত হয়ে আসছে। উক্ত সীমানায় একটি সংঘর্ষজাত ঘটনার সম্ভাবনা দেখা দিতেই বহুসংখ্যক গবেষণা শুরু হয়ে যায়, আর তাতে সীমানা সন্নিহিত অঞ্চলে প্ল্যাঙ্কটনিক ফোরামিনিফেরার বিলোপন নিয়ে মন্তব্য করা হয়। অবশ্য এই বিলোপনের নিদর্শন প্রকৃতপক্ষে ক্রি-প্যা সীমানায় কোনও এককালীন বড় বিলোপনের সূচক, নাকি ঐ সীমানা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিলুপ্তি ঘটনার সূচক, তাই নিয়ে দু'টি দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে।

বেন্থিক ফোরামিনিফেরার অনেক প্রজাতি এই বিলুপ্তি ঘটনায় লোপ পায়, হয়তো খাদ্যের জন্য জৈব বর্জ্যের উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতার কারণে। সমসাময়িক সমুদ্রে জৈব বর্জ্যের পরিমাণ কমে গিয়েছিল ধারণা করা হয়। অবশ্য বিলোপনের ধাক্কা সামলে ওঠার পর সামুদ্রিক অণুজীবদের পুনরায় বংশবৃদ্ধি আরম্ভ হলে বর্ধিত খাদ্যের উৎসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেন্থিক ফোরামিনিফেরাদেরও প্রজাতিকরণের হার বৃদ্ধি পায়। আদি প্যালিওসিনে বহুসংখ্যক কর্কর ভক্ষক বেন্থিক ফোরামিনিফেরার ভরণপোষণের জন্য উপযুক্ত সংখ্যায় ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন জন্মাতে থাকে। সব মিলিয়ে আদি প্যালিওসিনের বহু লক্ষ বছর ধরে ধীর গতিতে বেন্থিক অণুজীবরা প্রাক্‌-ক্রি-প্যা সীমানার সঙ্গে তুলনীয় সংখ্যায় ফিরে আসে।

সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডী

[সম্পাদনা]

ক্রি-প্যা সীমানা জুড়ে সামুদ্রিক মেরুদণ্ডীদের বিলোপনের হারের খতিয়ানে যথেষ্ট তারতম্য আছে। আপাতভাবে যে বিলোপনের হার সামনে আসে, তা সম্ভবতঃ প্রকৃত বিলোপনের চেয়ে জীবাশ্মের অভাবের দ্বারাই বেশি প্রভাবিত।

অস্ট্রাকড নামক ক্ষুদ্র কবচীদের (ক্রাস্টেশিয়ান) এক গোষ্ঠী আদি মাস্ট্রিক্টিয়ানে প্রভাবশালী ছিল, এবং তারা বিভিন্ন জায়গায় জীবাশ্ম রেখে গেছে। এই সমস্ত জীবাশ্মের পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় অস্ট্রাকডদের বৈচিত্র্য গোটা সিনোজোয়িক অধিযুগের মধ্যে প্যালিওজিন যুগেই সবচেয়ে কম ছিল। অবশ্য সাম্প্রতিক গবেষণার দ্বারাও এই বিষয়টি পরিষ্কার করা সম্ভব হয়নি যে, বৈচিত্র্যের এই হ্রাস ক্রি-প্যা সীমানার সমসাময়িক কিনা।

অন্ত্য ক্রিটেশিয়াসের স্ক্লেরাটিনিয়া প্রবাল গণেদের প্রায় ৬০% ক্রি-প্যা সীমানা পার করতে সক্ষম হয়নি। এই প্রবালদের বিলোপনের পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, উষ্ণ ও অগভীর ক্রান্তীয় সমুদ্রে বসবাসকারী ঔপনিবেশিক প্রবালের প্রায় ৯৮% এই সময়ে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যে সমস্ত প্রবাল একা থাকে অর্থাৎ যারা প্রবাল প্রাচীর নির্মাণ করে না এবং সমুদ্রের শীতলতর ও গভীরতর অঞ্চলে (আলোকিত অঞ্চলের নিচে) বাস করে, তাদের উপর উক্ত সীমানার বিলোপনের প্রভাব তেমন নয়। ঔপনিবেশিক প্রবালরা সালোকসংশ্লেষকারী শৈবালদের সঙ্গে মিথোজীবী জীবন কাটায়, আর ঐ সমস্ত শৈবাল ক্রি-প্যা সীমানাঘটিত বিপর্যয়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য প্রবালের জীবাশ্ম থেকে আহরিত তথ্য দিয়ে ক্রি-প্যা বিলোপন ও পরবর্তী প্যালিওসিন পুনরুত্থানের তত্ত্ব সমর্থন করতে গেলে গোটা ক্রি-প্যা সীমানা জুড়ে প্রবাল বাস্তুতন্ত্রসমূহে যে ক্রমপরিবর্তন ঘটে চলেছিল, তার কথাও বিবেচনা করতে হবে।

ক্রি-প্যা সীমানার অব্যবহিত পরে সেফালোপড, কন্টকত্বকী, ও ঝিনুকের গণসমূহ রীতিমত স্পষ্ট ক্ষয়ক্ষতি প্রদর্শন করে। যদিও সামুদ্রিক অমেরুদণ্ডীদের একটি ক্ষুদ্র পর্ব ব্র্যাকিওপডরা ক্রি-প্যা বিলুপ্তি ঘটনা কাটিয়ে ওঠে এবং আদি প্যালিওসিনে বহু শাখায় বিভক্ত হয়।

নটিলয়েড (আধুনিক নটিলিডা পর্ব যাদের জ্ঞাতি) এবং সিলয়েড (যা ক্রিটেশিয়াসেই আধুনিক অক্টোপাস, স্কুইড ও কাট্‌ল মাছে ভাগ হয়ে গিয়েছিল) ছাড়া অন্য সমস্ত সেফালোপোডা জাতীয় কম্বোজ শ্রেণির প্রাণি ক্রি-প্যা সীমানায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। এদের মধ্যে ছিল বাস্তুতন্ত্রগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বেলেম্‌নয়েড, এবং অতি বিচিত্র ও পরিব্যাপ্ত বাসস্থানের অধিকারী, খোলকযুক্ত সেফালোপড অ্যামোনয়েড। গবেষকরা দেখিয়েছেন, বেঁচে যাওয়া নটিলয়েডদের অল্পসংখ্যক ও বৃহত্তর ডিম দিয়ে প্রজননের পদ্ধতিটি বিলুপ্তি ঘটনার সময়ে অ্যামোনয়েডদের থেকে তাদেরকে এগিয়ে রাখতে পেরেছিল। অ্যামোনয়েডরা প্রজননের জন্য প্ল্যাঙ্কটনীয় পদ্ধতি অনুসরণ করত (অসংখ্য ডিম ও প্ল্যাঙ্কটনীয় লার্ভা), যা ক্রি-প্যা বিলুপ্তি ঘটনায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। অতিরিক্ত গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী বাস্তুতন্ত্র থেকে অ্যামোনয়েডদের বিলুপ্তির পর থেকে নটিলয়েডরা এক বিবর্তনীয় বিকিরণের মধ্য দিয়ে যায় এবং ক্রমশঃ অ্যামোনাইটদের মত জটিল খোলক ও অন্যান্য জটিল শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপ প্রদর্শন করে।

কন্টকত্বকী গণের প্রায় ৩৫% ক্রি-প্যা সীমানায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এদের মধ্যে যারা অন্ত্য ক্রিটেশিয়াসে ক্রান্তীয় অঞ্চলের অগভীর সমুদ্রে বাস করত, তারাই সবচেয়ে বেশি হারে বিলুপ্ত হয়। গভীর সমুদ্র ও মধ্য অক্ষাংশবাসী গণগুলির উপর এই বিলোপনের প্রভাব নগণ্য। বিলুপ্তির এই বিন্যাস থেকে বোঝা যায় বিশেষ করে অগভীর সমুদ্রে প্রবাল প্রাচীর-সংবলিত সমস্ত কার্বনেট প্ল্যাটফর্মের নিমজ্জন ও তজ্জনিত বাসস্থান লোপের ফলে বিলুপ্তি বেড়েছিল।

রুডিস্ট (প্রাচীর নির্মাতা ঝিনুক) ও ইনোসেরামিড (আধুনিক নোনাজলের ঝিনুকের দৈত্যাকার জ্ঞাতি) সমেত অন্যান্য অমেরুদণ্ডী গোষ্ঠীও ক্রি-প্যা সীমানায় বিলুপ্ত হয়েছিল।

ক্রি-প্যা সীমানার সমস্ত অংশ থেকে চোয়ালযুক্ত মাছের জীবাশ্মের খতিয়ান পাওয়া গেছে। এগুলির থেকে এই সমস্ত সামুদ্রিক মেরুদণ্ডী প্রজাতির বিলোপনের প্রকৃতি বিচার করা যায়। গভীর সমুদ্র অপেক্ষাকৃত অবিকৃত থাকতে পারলেও মুক্ত সমুদ্রের শীর্ষ খাদক এবং মহীসোপান অঞ্চলে ডেমার্সাল স্তরের খোলকভুক প্রজাতিদের মধ্যে সমমাত্রায় বিলোপনের প্রভাব দেখা যায়।

তরুণাস্থিবিশিষ্ট মাছেদের মধ্যে এই বিলুপ্তি ঘটনার পর নিওসেলাকিয়ানদের ৪১ টি গোত্রের মধ্যে ৭ টি, এবং ব্যাটয়েডদের (রে ও স্কেট মাছ) প্রায় সমস্ত শনাক্তকরণযোগ্য প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু অস্থিবিশিষ্ট মাছেদের প্রায় ৯০% গোত্র টিকে গিয়েছিল।

মাস্ট্রিক্টিয়ান অধোযুগে হাঙরদের ২৮ টি গোত্র ও ব্যাটয়েডদের ১৩ টি গোত্রের বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল, যাদের মধ্যে যথাক্রমে ২৫ টি ও ৯ টি গোত্র, কে-টি সীমানা পার করতে সক্ষম হয়। সমস্ত নিওসেলাকিয়ান গণের ৪৭ টি এই সীমানা পার করে, যাদের ৮৫% ছিল হাঙর। অন্যদিকে ব্যাটয়েডদের মধ্যে এই অনুপাত ছিল ১৫%, যা থেকে তাদের তুলনামূলকভাবে কম টিকে থাকার ক্ষমতার প্রমাণ মেলে।

আন্টার্কটিকার কাছে সিমুর দ্বীপে ক্রি-প্যা সীমানার অব্যবহিত উপরে একটি জীবাশ্মক্ষেত্রে অস্থিবিশিষ্ট মাছেদের গণবিলুপ্তির স্বাক্ষর পাওয়া গেছে। আপাতভাবে এটিকে ঐ সীমানা ও বিলুপ্তি ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে মনে করা হয়। অবশ্য মাছেদের বাসস্থানের সামুদ্রিক ও মিঠেজলের বাস্তুতন্ত্র সামগ্রিকভাবে পরিবেশে বিলুপ্তি ঘটনাটির প্রভাব কিছুটা কমিয়ে রাখতে পেরেছিল।

স্থলচর অমেরুদণ্ডী

[সম্পাদনা]

উত্তর আমেরিকার ১৪ টি ক্ষেত্রে সপুষ্পক উদ্ভিদের জীবাশ্মীভূত পাতায় পতঙ্গঘটিত ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন বিশ্লেষণ করে ক্রি-প্যা সীমানায় পতঙ্গদের বৈচিত্র্যের পরোক্ষ পরিমাপের কাজ চালানো হয়েছে, এবং তা থেকেই উক্ত প্রজাতিদের সমসাময়িক বিলোপনের হারও নির্ধারণের প্রচেষ্টা হয়েছে। গবেষকরা দেখেছেন, বিলুপ্তি ঘটনাটির আগে ক্রিটেশিয়াস ক্ষেত্রগুলিতে উদ্ভিদ ও পতঙ্গের ব্যাপক বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হত। কিন্তু আদি প্যালিওসিনে উদ্ভিদেরা বিচিত্র হলেও তাদের জীবাশ্মে পতঙ্গের আঘাতের চিহ্ন অনেক কম। পতঙ্গের এই অস্বাভাবিক অনুপস্থিতি বিলুপ্তি ঘটনাটির ১৭ লক্ষ বছর পরেও বজায় ছিল।

স্থলজ উদ্ভিদ

[সম্পাদনা]

ক্রি-প্যা সীমানায় স্থলে তাবৎ উদ্ভিদগোষ্ঠীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির অনেক প্রমাণ আছে। জীবাশ্মীভূত পাতা ও পরাগরেণু উভয়ের চর্চা থেকেই বিলুতির পরিষ্কার চিহ্ন উদ্ধার হয়। উত্তর আমেরিকায় এই সীমানার পূর্বেও বহুকোশী উদ্ভিদকুলে পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল, তবে বিলুপ্তি ঘটনাকালে তার ব্যাপ্তি বহুগুণ বেড়ে যায়। উত্তর আমেরিকান উদ্ভিদের ৫৭% ঐ ঘটনায় লোপ পায়। নিউজিল্যান্ড, আন্টার্কটিকা ইত্যাদি উচ্চ দক্ষিণ অক্ষাংশের ভূখণ্ডে উদ্ভিদদলের মধ্যে কোনও এককালীন বৃহৎ বিলোপন না ঘটলেও বিক্ষিপ্তভাবে বেশ কিছু প্রজাতি লোপ পায়। কোনও কোনও অঞ্চলে প্যালিওসিনে উদ্ভিদের পুনরুত্থান আরম্ভ হয় বিভিন্ন প্রজাতির ফার্নের বিস্তারের মাধ্যমে। এই বিস্তারকে ভূতত্ত্বের ভাষায় ফার্ন সমৃদ্ধি (ফার্ন স্পাইক) বলা হয়। সম্প্রতি ১৯৮০ খৃঃ মাউন্ট সেন্ট হেলেন্স অগ্ন্যুৎপাতের পর ফার্নের অনুরূপ বিস্তার দেখা গিয়েছিল।

ক্রি-প্যা সীমানায় উদ্ভিদকুলের ব্যাপক হারে বিলোপনের ফলে ছত্রাক ইত্যাদি মৃতজীবী জীবগোষ্ঠীর বাড়বাড়ন্ত হয়। এই সমস্ত জীব সালোকসংশ্লেষ করে না, এবং পচনশীল উদ্ভিদদেহ থেকে পুষ্টিরস শোষণ করে। যে অল্প কয়েক বছর সূর্যালোক ঢাকা ছিল আর পুষ্টির জন্য মাটিতে যথেষ্ট পচনশীল জৈব পদার্থ উপলভ্য ছিল, কেবল সেই সময়টুকুতেই ছত্রাক ইত্যাদির প্রাধান্য বজায় ছিল। বায়ুমণ্ডল স্বচ্ছ হয়ে যাওয়ার পর ফার্ন ও অন্যান্য ভূসংলগ্ন সালোকসংশ্লেষকারী জীব ও ক্রমশঃ সমস্ত বৃহৎ উদ্ভিদ প্রত্যাবর্তন করে। বিলুপ্তি ঘটনাটির অব্যবহিত পরের বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে ফার্নের দুইটি মাত্র প্রজাতি রাজত্ব করেছিল বলে অনুমান করা হয়।

পলিপ্লয়ডির ফলে সপুষ্পক উদ্ভিদরা বিলুপ্তি ঘটনার ধাক্কা সহ্য করতে পেরেছিল। এর সম্ভাব্য কারণ হল তাদের উপলভ্য জিনের অনেকগুলি অনুলিপি থাকার ফলে তারা বেশি দ্রুততার সঙ্গে দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিবেশে অভিযোজিত হতে পেরেছিল।

ক্রি-প্যা সীমানায় উভচরদের বিলোপনের নমুনা সীমিত। মন্টানায় ঐ সীমানায় প্রাপ্ত জীবাশ্মীভূত মেরুদণ্ডী নমুনাসমূহের একটি গবেষণা এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছায় যে, ঐ বিলুপ্তি ঘটনায় কোনও উভচর প্রজাতিই লুপ্ত হয়নি। কিন্তু এই গবেষণার অন্তর্গত নয় এমন অনেক মাস্ট্রিক্টিয়ান উভচরের প্রজাতি ছিল, যাদের চিহ্ন প্যালিওসিনে পাওয়া যায় না। এদের মধ্যে পড়ে থিয়াটোনিয়াস ল্যান্সেন্সিস ব্যাঙ, এবং অ্যালবানার্পেটন গ্যালাক্টিয়ন নামক অ্যালবানার্পেটনিড। অতঃপর অন্ততঃ কিছু কিছু উভচর প্রজাতি ক্রি-প্যা সীমানায় লুপ্ত হয়েছিল এ'কথা বলা যায়। উভচরদের আপাত অপেক্ষাকৃত কম বিলোপনের হার সম্ভবতঃ সামগ্রিকভাবে মিঠেজলের প্রাণিদের কম বিলোপনের হারের সঙ্গে জড়িত।

অনার্কোসর

[সম্পাদনা]

করিস্টোডেরা

[সম্পাদনা]

করিস্টোডেরা (আংশিক জলচর আর্কোসরোমর্ফ)-রা ক্রি-প্যা সীমানা অতিক্রম করতে সমর্থ হয়, কিন্তু আদি মায়োসিনে লোপ পায়। চ্যাম্পোসরাসের মূর্ধার দাঁতের একটি গবেষণায় দেখা যায়, এদের বিভিন্ন প্রজাতির খাদ্যাভ্যাসে K-T ঘটনার ফলে পরিবর্তন এসেছিল।

কচ্ছপ

[সম্পাদনা]

ক্রিটেশিয়াসের যাবতীয় কচ্ছপ প্রজাতির প্রায় ৮০% ক্রি-প্যা সীমানা পার করেছিল। তারা যে ছয়টি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাদের প্রতিটিই প্যালিওজিনে প্রবেশ করে এবং আজও তাদের প্রত্যেকের উত্তরাধিকারী প্রজাতি পৃথিবীতে বেঁচে আছে।

লেপিডোসরিয়া

[সম্পাদনা]

বর্তমান অনার্কোসর সরীসৃপদের অন্তর্গত লেপিডোসরিয়া গোষ্ঠী (সাপ, গিরগিটি, তুয়াতারা) ক্রি-প্যা সীমানা পার করেছিল। স্কোয়ামাটারাও এদেরই একটি শাখা। আজকের তুয়াতারা-রা রাইনোসেফালিয়ানদের শেষ প্রতিনিধি।

আদি মেসোজোয়িকে রাইনোসেফালিনরা, লেপিডোসরিয়াদের একটি বৃহৎ ও বিস্তৃত শাখা ছিল, কিন্তু ক্রিটেশিয়াসের মাঝামাঝি থেকে তাদের প্রভাব কমতে শুরু করে। অবশ্য অন্ত্য ক্রিটেশিয়াসেও দক্ষিণ আমেরিকায় তাদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। আজ তাদের জীবন্ত প্রতিনিধি নিউজিল্যান্ডের একটিমাত্র গণ।

স্কোয়ামাটা বর্গের বর্তমান প্রতিনিধি টিকটিকি ও গিরগিটি, সাপ, এবং আম্ফিসবেনিয়ান (কৃমিসদৃশ গিরগিটি)-রা। এরা জুরাসিক যুগে বিবর্তনীয় বিকিরণের মাধ্যমে বিভিন্ন বাস্তুতান্ত্রিক ধাপ অধিকার করতে থাকে, এবং গোটা ক্রিটেশিয়াস জুড়ে সফল ত্থেকে যায়। এরা ক্রি-প্যা সীমানা অতিক্রম করে আজকের সরীসৃপদের মধ্যে সবচেয়ে সফল ও বিচিত্র গোষ্ঠী হিসেবে রয়েছে। এদের অন্তর্গত এখন ৬০০০ এরও বেশি প্রজাতি। অবশ্য স্থলচর স্কোয়ামেটদের অনেকগুলি গোত্র ক্রি-প্যা সীমানায় লুপ্ত হয়েছিল, যেমন মনস্টারসরিয়ান ও পলিগ্লিফানোডন্ট, এবং জীবাশ্ম প্রমাণ থেকে জানা যায় সমস্ত স্কোয়ামাটাই ঐ সীমানায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং প্রাক্‌-বিলুপ্তি ঘটনার স্থিতি পুনরুদ্ধার করতে তাদের প্রায় এক কোটি বছর লেগে গিয়েছিল। মোসাসরাস, প্লীসিওসরাস প্রভৃতি বৃহৎ অনার্কোসর জলচর সরীসৃপ ছিল সমসাময়িক সমুদ্রের শীর্ষ খাদক। এরা ক্রিটেশিয়াসের শেষভাগে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ক্রিটেশিয়াস–প্যালিওজিন বিলুপ্তি ঘটনার পূর্বেই জীবাশ্মের খতিয়ান থেকে ইকথিওসরাসরা উধাও হয়ে গিয়েছিল।

আর্কোসর

[সম্পাদনা]

আর্কোসর ক্লেডের অন্তর্গত হল দুটি জীবিত গোষ্ঠী, ক্রোকোডাইলিফর্ম ও পাখি। এছাড়া অধুনা বিলুপ্ত উড্ডয়নে অক্ষম ডাইনোসর এবং টেরোসরদের যাবতীয় শাখা এদের মধ্যে পড়ে।

ক্রোকোডাইলিফর্ম

[সম্পাদনা]

মাস্ট্রিক্টিয়ান জীবাশ্ম বিবরণে ক্রোকোডাইলিয়ান ও তাদের জ্ঞাতি মিলিয়ে দশটি গোত্রের চিহ্ন পাওয়া যায়। এদের মধ্যে পাঁচটি ক্রি-প্যা সীমানা অতিক্রম করতে ব্যর্থ হয়। অন্য পাঁচটি গোত্রের জীবাশ্ম মাস্ট্রিক্টিয়ান ও প্যালিওসিন দুই দিক থেকেই পাওয়া গেছে। জীবিত সব কয়টি ক্রোকোডাইলিফর্ম গোত্রই স্থলে বা মিঠেজলের পরিবেশে বাস করত। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ড্রাইরোসরিডি, যারা মিঠেজল ও নোনাজল উভয় পরিবেশেই থাকত। বিলুপ্তি ঘটনা এড়াতে ক্রোকোডাইলিফর্মদের সাফল্য সম্ভবতঃ এসেছিল তাদের অংশতঃ জলচর জীবনযাত্রা এবং মাটিতে গর্ত করে থাকার ক্ষমতার দৌলতে। গর্তে ঢুকে গেলে বাইরের প্রতিকূল পরিবেশের ক্ষতিকর প্রভাব অনেকাংশে এড়ানো যায়। ২০০৮ খৃঃ ইয়ুভ ও সহকর্মীরা প্রস্তাব দেন যে আধুনিক সামুদ্রিক কুমিরছানারা যেমন জীবনের প্রথম কিছুদিন মিঠেজলে থাকে, তাদের ক্রিটেশিয়াস-প্যালিওজিনবাসী পূর্বজদের ছানাপোনারাও তেমনি মিঠেজলে থাকত, যার ফলে অন্যান্য সামুদ্রিক সরীসৃপ লুপ্ত হয়ে গেলেও তারা বেঁচে যায়। বিলুপ্তি ঘটনাটিতে মিঠেজলের বাস্তুতন্ত্র নোনাজলের বাস্তুতন্ত্রের মত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।

টেরোসর

[সম্পাদনা]

টেরোসরদের একটি গোত্র আঝদার্কিডি অবশ্যই মাস্ট্রিক্টিয়ানে বেঁচে ছিল, আর ক্রিটেশিয়াস-প্যালিওজিন বিলুপ্তির সময়ে লুপ্ত হয়ে যায়। এরা ছিল মধ্য ক্রিটেশিয়াসের দশটি গোত্র সংবলিত একটি ক্রমহ্রাসমান শাখার শেষ প্রতিনিধি। মাস্ট্রিক্টিয়ানে আরও অনেক টেরোসর গোত্রের অস্তিত্বের সম্ভাবনা আছে, যেমন অর্নিথোকেইরিড, টেরানোডোনিড, নিক্টোসরিড ও সম্ভবতঃ টাপেজারিড, যদিও শেষোক্ত গোত্রটির কেবল আংশিক অবশেষই পাওয়া গেছে এবং সেগুলিকে নির্দিষ্ট কোনও গোষ্ঠীর বলে দাগিয়ে দেওয়া মুশকিল। টেরোসরদের বিলোপন চলাকালীনই পাখিদের বিবর্তনীয় বিকিরণ চলছিল; আগে মনে করা হত আধুনিক পাখিরা এই সময়ে প্রত্যক্ষ প্রতিযোগিতা বা খালি বাস্তুতান্ত্রিক ধাপ পূরণ করার সুবাদে প্রাচীন পাখি ও টেরোসরদের হারিয়ে দেয়। কিন্তু টেরোসর ও পাখিদের বিবর্তনীয় উত্থান ও পতনের মধ্যে কোনও কার্যকারণ সম্পর্কের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। অন্ত্য ক্রিটেশিয়াস পর্যন্তও কিছু কিছু ক্ষুদ্রাকার টেরোসর টিঁকে ছিল। এমনকি ক্রি-প্যা ঘটনার ঠিক আগে বাস্তুতন্ত্রের কোনও কোনও ধাপ এই টেরোসরেরা পাখিদের কাছ থেকে ছিনিয়েও নিয়েছিল।

অধিকাংশ পুরাজীববিদ পাখিদেরকে ডাইনোসরদের একমাত্র জীবিত প্রতিনিধি মনে করেন (দেখুন পাখিদের উৎপত্তি)। মনে করা হয় এনান্টিঅর্নিথিন ও হেস্পারর্নিথিফর্ম সমেত সমস্ত উড্ডয়নে অক্ষম থেরোপডই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। পাখিদের জীবাশ্মের বারংবার বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় ক্রি-প্যা ঘটনার আগে পাখিদের প্রজাতিকরণ হয়েছিল, আর হাঁস, মুরগি ও র‍্যাটাইট পাখিরা উড্ডয়নে অক্ষম ডাইনোসরদের সঙ্গে একই সময়ে বাস করত। বিভিন্ন পক্ষী-প্রজাতির বহুসংখ্যক জীবাশ্ম থেকে ক্রি-প্যা সীমানার তিন লক্ষ বছর আগে পর্যন্ত প্রাচীন পাখিদের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। ঐ সীমানার পরে প্যালিওজিনে এদের আর কোনও চিহ্ন দেখা যায় না; অর্থাৎ তখন পাখিদেরও একটি বৃহৎ বিলোপনের শিকার হতে হয়েছিল। ক্রিটেশিয়াসের যাবতীয় পাখিদের এক সামান্য অংশই প্যালিওজিনে টিঁকে ছিল। এদের থেকেই আজকের যাবতীয় পাখি এসেছে। এভিসরাই একমাত্র পক্ষীগোষ্ঠী যারা নিশ্চিতভাবে ক্রিটেশিয়াস–প্যালিওজিন বিলুপ্তি ঘটনা পেরিয়ে এসেছিল। এদের বেঁচে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয় ডুব দেওয়া, সাঁতার কাটা, আর জলাজঙ্গলে ও ঝোপেঝাড়ে আশ্রয় নেওয়ার ক্ষমতার জন্য এদের সুবিধা হয়েছিল। এভিয়ানদের অনেক প্রজাতি মাটি খুঁড়তে পারে, বা গর্তের মধ্যে বা উইঢিপিতে বাসা করে থাকতে পারে। এই সমস্ত গুণই ক্রি-প্যা সীমানায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব প্রতিহত করতে সাহায্য করেছিল। বিলুপ্তি ঘটনার পরে তাদের দীর্ঘমেয়াদী অস্তিত্ব সুনিশ্চিত হয়েছিল বাস্তুতন্ত্রে অধুনা বিলুপ্ত, উড্ডয়নে অক্ষম ডাইনোসরদের ছেড়ে যাওয়া ধাপগুলি পূরণ করার মাধ্যমে।

উড্ডয়নে অক্ষম ডাইনোসর

[সম্পাদনা]

কয়েকটি বিতর্র্কিত দাবিকে অগ্রাহ্য করলে সমস্ত বিজ্ঞানীই মানেন যে সমস্ত উড্ডয়নে অক্ষম ডাইনোসরই ক্রি-প্যা সীমানায় লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ডাইনোসরদের জীবাশ্মের খতিয়ান থেকে অবশ্য বিলুপ্তি ঘটনাটির পূর্বে কয়েক লক্ষ বছর ধরে তাদের বৈচিত্র্যের হ্রাস এবং বৈচিত্র্যের অক্ষুণ্ণতা - দুটি পরস্পরবিরোধী দাবিকেই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা দেখা গেছে। হতে পারে যে প্রকৃতপক্ষে এই খতিয়ান স্রেফ এখনও পর্যন্ত কোনও একটি দাবিকে প্রতিষ্ঠা করার মত নিখুঁত হয়ে উঠতে পারেনি। অন্ত্য মাস্ট্রিক্টিয়ান ডাইনোসরেরা মাটি খুঁড়তে, সাঁতার কাটতে বা ডুব দিতে পারত কিনা তার কোনও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। যদি না পেরে থাকে, তাহলে বিলুপ্তি ঘটনার প্রবল প্রতিকূল পরিবেশ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে তারা অসমর্থ ছিল। ছোট ডাইনোসরেরা সত্যিই ঘটনার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে থাকতে পারে, কিন্তু তারপর তাদের খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছিল; শাকাহারীদের ঘাসপাতার যোগান কমে গিয়েছিল, ফলে মাংসাশীদের শিকারের সরবরাহে টান পড়েছিল।

ডাইনোসরেরা যে উষ্ণশোণিত ছিল সেই সম্বন্ধে ক্রমশঃ বিজ্ঞানীরা একমত হচ্ছেন। এই তথ্যটিও ক্রোকোডিলিয়ানদের সাপেক্ষে তাদের টিঁকে থাকার ব্যর্থতায় আলোকপাত করে। অনুষ্ণশোণিত কুমিররা অনাহারেও বহুদিন বাঁচতে পারে (কয়েক মাস পর্যন্ত), কিন্তু একই আয়তনের উষ্ণশোণিত প্রাণিদের দ্রুততর বিপাক হার বজায় রাখার জন্য অনেক বেশি খাদ্যের প্রয়োজন হয়। ফলে বিলুপ্তি ঘটনার সময়ে খাদ্যের চূড়ান্ত অভাব সহ্য করে কোনও বড় ডাইনোসরই বাঁচতে পারেনি, কিন্তু কিছু কিছু কুমির বেঁচে গিয়েছিল। অন্যান্য উষ্ণশোণিত প্রাণি, যেমন স্তন্যপায়ী ও পাখিদের বেঁচে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলা যায় বিলুপ্তি ঘটনার সময়ে তাদের অপেক্ষাকৃত ছোট আয়তনের কথা, যার ফলে তাদের খাদ্যের প্রয়োজন হত অপেক্ষাকৃত কম।

বিলুপ্তিটি এককালীন ও ব্যাপক ছিল, নাকি ক্রমান্বয়ে সংঘটিত হয়েছিল তাই নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ আছে। আগেই বলা হয়েছে জীবাশ্মের খতিয়ান ঘেঁটে উভয় মতের পক্ষেই সমর্থন টানা হয়। ২০১০ খৃঃ ইউরোপের ক্যাটালান পিরেনিজ পর্বতমালায় ২৯ টি জীবাশ্মক্ষেত্রের একটি বিশ্লেষণে দেখা যায় যে গ্রহাণু সংঘাতের আগে অবধি সেখানকার ডাইনোসরদের বৈচিত্র্য ছিল যথেষ্ট, প্রায় ১০০ টি প্রজাতির চিহ্ন সেখানে ছিল। আরও সাম্প্রতিক গবেষণা অবশ্য জানিয়েছে যে, ঐ সংখ্যা ট্যাফোনমিকাল বায়াসের দোষে দুষ্ট, আর মহাদেশীয় জীবাশ্মের অপেক্ষাকৃত দুর্লভ্যতার কারণেও পূর্ববর্তী গবেষণাটিতে ভুল হয়ে থাকতে পারে। আনুমানিক প্রকৃত বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্যের উপর নির্ধারিত উক্ত প্রথম গবেষণাটির ফলাফল থেকে দেখা যায় যে ক্রিটেশিয়াস যুগের শেষভাগে উড্ডয়নে অক্ষম ডাইনোসরদের জীবিত প্রজাতির সংখ্যা ছিল ৬২৮ থেকে ১০৭৮ এর মধ্যে, যারা ক্রিটেশিয়াস–প্যালিওজিন বিলুপ্তি ঘটনায় আকস্মিকভাবে লুপ্ত হয়ে যায়। আবার, কানাডার অ্যালবার্টার রেড ডিয়ার নদী অববাহিকায় প্রাপ্ত জীবাশ্মের বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ক্রিটেশিয়াসের শেষ এক কোটি বছরে ডাইনোসরদের বিলুপ্তি ছিল ক্রমিক; সেখানে ঐ দীর্ঘ সময়ে ডাইনোসরদের প্রজাতিসংখ্যা ৪৫ থেকে হ্রাস পেয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১২ তে। অন্যান্য বিজ্ঞানীও গবেষণাপূর্বক এই ফলাফল স্বীকার করেছেন।

অনেক গবেষক প্যালিওসিনে উড্ডয়ন-অক্ষম ডাইনোসরের অস্তিত্বের তত্ত্ব স্বীকার করেন। এই তত্ত্বের ভিত্তি হল হেল ক্রিক প্রস্তরক্ষেত্রে ক্রি-প্যা সীমানার প্রায় ১.৩ মিটার (৪ ফুট ৩.২ ইঞ্চি) উপরে অর্থাৎ ৪০,০০০ বছর পরের পাথরের স্তরে প্রাপ্ত ডাইনোসর জীবাশ্ম। কলোরাডোর সান জুয়ান নদী অববাহিকায় ওহো অ্যালামো বেলেপাথরে একটি হ্যাড্রোসরের ঊর্বস্থির কাছাকাছি কিছু পরাগরেণুর নমুনা পাওয়া গেছে, যার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে প্রাণিটি ৬.৪৫ কোটি বছর আগে সিনোজোয়িক অধিযুগেই (ক্রি-প্যা বিলুপ্তি ঘটনার প্রায় ১০ লক্ষ বছর পর) বেঁচে ছিল। এই সমস্ত ডাইনোসরের উত্তর-ক্রি-প্যা অস্তিত্ব সর্বজনীনভাবে প্রমাণিত হলে এই হ্যাড্রোসরিডদের "মৃত চলমান ক্লেড"-এর তকমা দেওয়া হবে। বর্তমানে বিজ্ঞানীদের সম্মিলিত মত অবশ্য এই যে, এই সমস্ত জীবাশ্ম তাদের আসল স্থান থেকে ভূমিক্ষয়ের ফলে বিচ্যুত হয়ে নবীনতর পলিস্তরের নিচে নতুন করে চাপা পড়ে যায়।

স্তন্যপায়ী

[সম্পাদনা]

মনোট্রিম বা হংসচঞ্চু (অণ্ডজ স্তন্যপায়ী), মাল্টিটিউবারকুলেট, মেটাথেরিয়ান, ইউথেরিয়ান, ড্রায়োলেস্ট্রয়ডিয়ান, গণ্ডোয়ানাথেরেস প্রভৃতি সমস্ত মূল স্তন্যপায়ী গোষ্ঠীই ক্রি-প্যা সীমানা অতিক্রম করতে সমর্থ হয়েছিল, যদিও এদের প্রত্যেককেই কমবেশি ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। বিশেষভাবে উল্লেখ করার মত ঘটনা হল, উত্তর আমেরিকা থেকে মেটাথেরিয়ানরা প্রায় লুপ্ত হয়ে যায়, আর এশীয় ডেল্টাথেরয়ডিয়ানরা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায় (কেবল গুর্বানোডেল্টার পূর্বসূরীরা টিঁকে থাকে)। উত্তর আমেরিকার হেল ক্রিক প্রস্তরক্ষেত্রে প্রাপ্ত দশটি মাল্টিটিউবারকুলেট প্রজাতির অন্ততঃ পাঁচটি, এবং এগারোটি মেটাথেরিয়ান প্রজাতির সবগুলিই ক্রি-প্যা সীমানার উপর নিশ্চিহ্ন। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় মাল্টিটিউবারকুলেটরা অপেক্ষাকৃত অক্ষত অবস্থায় থাকে ও প্যালিওসিনে দ্রুত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। এশিয়ার বাস্তুতন্ত্রে অবশ্য তারা আর কখনও উল্লেখযোগ্যভাবে ফিরে আসতে পারেনি। একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, মাল্টিটিউবারকুলেটদের পরেই মেটাথেরিয়ানরা ক্রি-প্যা সীমানায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল; ইউথেরিয়ানরা সবচেয়ে দ্রুত সামলে ওঠে।

আদিম স্তন্যপায়ীরা ক্রি-প্যা ঘটনার মোটামুটি তিন কোটি বছর আগে থেকে বিভিন্ন প্রজাতিতে ভাগ হতে শুরু করে। ক্রি-প্যা সীমানায় এসে এই প্রজাত্যায়নের প্রক্রিয়া থমকে যায়। সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা যায় যে, ডাইনোসরদের বিলুপ্তির ফলে বাস্তুতন্ত্রে ফাঁক তৈরি হলেও স্তন্যপায়ীরা শীঘ্রই বিবর্তিত হয়ে সেইসব স্থান দখল করে উঠতে পারেনি। কোনও কোনও স্তন্যপায়ী বর্গ অবশ্য ক্রি-প্যা সীমানার অব্যবহিত পরেই বহু শাখায় ভাগ হতে আরম্ভ করেছিল, যেমন কাইরপ্টেরা (বাদুড়) ও সিটার্টিওড্যাক্টাইলা (তিমি, ডলফিন ও গবাদি পশুর পূর্বসূরী)। বর্তমান গবেষকরা মনে করেন কেবলমাত্র মার্সুপিয়াল বর্গগুলোই উক্ত সীমানার অব্যবহিত পরে শাখায় ভাগ হয়েছিল।

ক্রি-প্যা সীমানার সমসাময়িক স্তন্যপায়ী প্রজাতিগুলো ছিল সাধারণত আয়তনে ছোট; ইঁদুরের সঙ্গে তুলনীয়। এই ছোট আয়তনের জন্য তারা সুরক্ষিত স্থানে সহজে লুকিয়ে থাকতে পেরেছিল। এছাড়া অনুমান করা হয় যে, কোনও কোনও হংসচঞ্চু, মার্সুপিয়াল এবং প্ল্যাসেন্টাল প্রজাতি অংশতঃ জলচর ছিল, আর মাটি খুঁড়ে থাকার কায়দা রপ্ত করে ফেলেছিল। আজও এদের অনেক উত্তরসূরীর এই সমস্ত অভ্যাস দেখতে পাওয়া যায়। ক্রি-প্যা ঘটনার প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে যুঝতে এই ধরনের আচরণ সহায়ক হয়েছিল।

প্রমাণ

[সম্পাদনা]

উত্তর আমেরিকায় প্রাপ্ত জীবাশ্ম

[সম্পাদনা]

উত্তর আমেরিকার ভূগাঠনিক স্তরবিন্যাসে ক্রি-প্যা বিলুপ্তি ঘটনার চিহ্ন সবচেয়ে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় অন্ত্য মাস্ট্রিক্টিয়ানের ঘনসন্নিবিষ্ট প্যালিনোমর্ফ খতিয়ান ও তার অব্যবহিত পরে সীমানার পরবর্তী ফার্ন স্পাইকের তুলনার মাধ্যমে।

এখনও পর্যন্ত ক্রি-প্যা সীমানা থেকে খুঁজে পাওয়া বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ডাইনোসর জীবাশ্মসংবলিত পাথরের স্তর পশ্চিম উত্তর আমেরিকাতেই মেলে, বিশেষ করে মন্টানার হেল ক্রিক প্রস্তরক্ষেত্রের নাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এটির সঙ্গে ঐ রাজ্যেরই জুডিথ নদী অববাহিকার প্রস্তরক্ষেত্র এবং আলবার্টা রাজ্যের ডাইনোসর পার্ক প্রস্তরক্ষেত্রের তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে ক্রিটেশিয়াস যুগের শেষ এক কোটি বছরে ডাইনোসরদের সংখ্যার হ্রাসবৃদ্ধির আন্দাজ করা যায়। উল্লিখিত দু'টি প্রস্তরক্ষেত্রেরই বয়স সাড়ে সাত কোটি বছর। অবশ্য এই সমস্ত জীবাশ্ম একটি মাত্র মহাদেশের একটি সামান্য অংশকেই উপস্থাপিত করে।

মধ্য থেকে অন্ত্য কাম্পানিয়ান প্রস্তরক্ষেত্রগুলোর ডাইনোসর জীবাশ্মে অন্যান্য যুগের চেয়ে বেশি বৈচিত্র্য দেখা যায়। অন্ত্য মাস্ট্রিক্টিয়ানে বিভিন্ন ক্লেডের বৃহত্তম প্রজাতিদের দেখা মেলে। টির‍্যানোসরাস, অ্যাঙ্কিলোসরাস, প্যাকেসেফালোসরাস, ট্রাইসেরাটপ্‌স, টোরোসরাস ইত্যাদির নাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এ'থেকে বোঝা যায় বিলুপ্তির ঠিক আগে পৃথিবীতে খাদ্য ছিল প্রচুর।

বহুসংখ্যক ডাইনোসর জীবাশ্মের পাশাপাশি ক্রি-প্যা সীমানার পরে অজস্র উদ্ভিদ জীবাশ্মেরও আকস্মিক হ্রাস দেখা যায়। সীমানার নিচে গুপ্তবীজী পরাগরেণুর প্রাচুর্য থাকলেও সীমানার মধ্যে তাদের সংখ্যা খুব কম; বরং ফার্নের স্পোর সেখানে অত্যধিক। সীমানার উপরের স্তরগুলিতে ক্রমে ক্রমে পরাগরেণুর পরিমাণ বেড়ে উঠতে দেখা যায়। এই ঘটনা আধুনিক আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের প্রভাবের সঙ্গে তুলনীয়। অগ্ন্যুৎপাতের পরেও উদ্ভিদকুলের প্রত্যাবর্তনে আগে আসে ফার্ন, এবং তারপর ধীরে ধীরে আসে অন্যান্য উদ্ভিদ তথা গুপ্তবীজী।

সামুদ্রিক জীবাশ্ম

[সম্পাদনা]

সামুদ্রিক প্ল্যাঙ্কটনের বিলুপ্তি ক্রি-প্যা সীমানার সঙ্গে সমাপতিত হতে দেখা যায়, এবং এর প্রভাবও ছিল ব্যাপক। অ্যামোনাইটদের সবক'টি গণ সীমানার কাছাকাছি বা সীমানায় বিলুপ্ত বা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। অবশ্য সমগ্র ক্রিটেশিয়াস যুগ জুড়েই ধীরে ধীরে বেশ কিছু অ্যামোনাইটের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছিল। অধিকাংশ ইনোসেরামিড ঝিনুকের বিলুপ্তিও ক্রি-প্যা সীমানার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল।

নিপুণতর বিশ্লেষণের ফলে বোঝা যায়, অন্ত্য ক্রিটেশিয়াসে একইসঙ্গে বেশ কিছু প্রক্রিয়া চলছিল যাদের সম্মিলিত প্রভাব বাড়তে বাড়তে অন্তিম মহাবিলুপ্তির আকস্মিকতায় এসে শেষ হয়। ক্রি-প্যা সীমানার কাছাকাছি বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে ওঠার ফলে জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৬৫ কোটি ৪০ লক্ষ বছর থেকে ৬৫ কোটি ২০ লক্ষ অছর আগে পর্যন্ত গড় তাপমাত্রা তিন থেকে চার ডিগ্রি বেড়ে গিয়েছিল। এর সঙ্গে সামুদ্রিক তাপমাত্রা কমে যাওয়ার ফলে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যও হ্রাস পায়।

মহাসুনামি

[সম্পাদনা]

বিজ্ঞানীরা একমত যে ক্রি-প্যা সীমানার গ্রহাণু সংঘর্ষের ফলে যে বিশাল ঢেউয়ের উৎপত্তি হয়, তার ফলেই ক্যারিবিয়ান সাগরমেক্সিকো উপসাগর সন্নিহিত অঞ্চলে বর্তমানে সঞ্চিত মহাসুনামির অধঃক্ষেপের সৃষ্টি হয়েছিল। উত্তর-পূর্ব মেক্সিকোর লা পোপা অববাহিকা, উত্তর-পূর্ব ব্রাজিলের স্তরীভূত কার্বোনেট, এবং অতলান্তিকের গভীর সমুদ্রে সঞ্চিত পলি থেকে এই অধঃক্ষেপের আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে। খোদ চিক্সুলাব উল্কাখাতে সংঘর্ষের পরমুহূর্তে ভূগর্ভ থেকে উৎক্ষিপ্ত জমাট বাঁধা গ্রানাইটের স্তরের উপরেও ১০০ মিটার (৩৩০ ফুট) পুরু বালির রূপে এই অধঃক্ষেপের দেখা মেলে। এরকম বালির এত পুরু স্তর পৃথিবীতে আর কোথাও নেই।

গ্রহাণুটি অপেক্ষাকৃত অগভীর সমুদ্রে পড়েছিল বলে এই মহাসুনামির উচ্চতা অনুমান করা হয় ১০০ মিটারের কিছু বেশি। গভীর সমুদ্রে পড়লে এটির উচ্চতা হত কমবেশি ৪.৬ কিমি (২.৯ মাইল)।

সংঘর্ষের সময়ে অধঃক্ষিপ্ত শিলায় সঞ্চিত জীবাশ্ম

[সম্পাদনা]

সম্প্রতি মেক্সিকো উপসাগর সন্নিহিত অঞ্চলে ক্রি-প্যা সংঘর্ষের সময়ে সঞ্চিত জীবাশ্ম-সমৃদ্ধ শিলাস্তরের খোঁজ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আছে সুনামির সঙ্গে ধুয়ে আসা ম্যানগ্রোভ জাতীয় অরণ্যের অবশেষ, যা থেকে বোঝা যায় সংঘর্ষের অব্যবহিত পরে মেক্সিকো উপসাগরের জল বারংবার চলকে উপকূলভাগ ধুয়ে দিয়েছিল। এর ফলে ম্যানগ্রোভের সঙ্গেই অগভীর জলে প্রচুর মাছের দেহাবশেষও জমা হয়, কিন্তু সেই সমস্ত মাছ খাওয়ার মত কোনও খাদক জীবিত ছিল না।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "International Chronostratigraphic Chart"। International Commission on Stratigraphy। ২০১৫। মে ৩০, ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ এপ্রিল ২০১৫ 
  2. Renne, Paul R.; Deino, Alan L.; Hilgen, Frederik J.; Kuiper, Klaudia F.; Mark, Darren F.; Mitchell, William S.; Morgan, Leah E.; Mundil, Roland; Smit, Jan (৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩)। "Time Scales of Critical Events Around the Cretaceous-Paleogene Boundary" (পিডিএফ)Science339 (6120): 684–687। ডিওআই:10.1126/science.1230492পিএমআইডি 23393261বিবকোড:2013Sci...339..684R। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ জুলাই ২০১৯ 
  3. Fortey, Richard (১৯৯৯)। Life: A Natural History of the First Four Billion Years of Life on Earth। Vintage। পৃষ্ঠা 238–260। আইএসবিএন 978-0-375-70261-7 
  4. Muench, David; Muench, Marc; Gilders, Michelle A. (২০০০)। Primal Forces। Portland: Graphic Arts Center Publishing। পৃষ্ঠা 20। আইএসবিএন 978-1-55868-522-2 
{{bottomLinkPreText}} {{bottomLinkText}}
ক্রিটেশিয়াস–প্যালিওজিন বিলুপ্তির ঘটনা
Listen to this article

This browser is not supported by Wikiwand :(
Wikiwand requires a browser with modern capabilities in order to provide you with the best reading experience.
Please download and use one of the following browsers:

This article was just edited, click to reload
This article has been deleted on Wikipedia (Why?)

Back to homepage

Please click Add in the dialog above
Please click Allow in the top-left corner,
then click Install Now in the dialog
Please click Open in the download dialog,
then click Install
Please click the "Downloads" icon in the Safari toolbar, open the first download in the list,
then click Install
{{::$root.activation.text}}

Install Wikiwand

Install on Chrome Install on Firefox
Don't forget to rate us

Tell your friends about Wikiwand!

Gmail Facebook Twitter Link

Enjoying Wikiwand?

Tell your friends and spread the love:
Share on Gmail Share on Facebook Share on Twitter Share on Buffer

Our magic isn't perfect

You can help our automatic cover photo selection by reporting an unsuitable photo.

This photo is visually disturbing This photo is not a good choice

Thank you for helping!


Your input will affect cover photo selection, along with input from other users.

X

Get ready for Wikiwand 2.0 🎉! the new version arrives on September 1st! Don't want to wait?